অশ্লীল পত্রপত্রিকার ভয়াবহতা

No comments:
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এ যুগের মুসলমানরা মহাবিপদে পতিত হয়েছে। তাদেরকে চতুর্দিক দিয়ে ফিতনা ফাসাদে ঘিরে রেখেছে এবং অনেক মুসলমানই সে ফিতনার সহজ শিকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের গুনাহ ও অসৎকাজগুলো প্রকাশ পাচ্ছে। তারা মানুষকে নির্ভয়ে নির্লজ্জভাবে গুনাহের দিকে আহ্বান করছে। এসব ভয়াবহ কাজ খুব বেশি আকারে হওয়ার কারণ হলো আল্লাহর দীনকে অবজ্ঞা, তাঁর নির্ধারিত সীমারেখা ও শরিআতের প্রতি অসম্মান এবং আল্লাহর শরিআত বাস্তবায়নে বহু মুসলমানের অবহেলা, সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ থেকে বিরত থাকা। আল্লাহর দরবারে খাস তাওবা, তাঁর আদেশ-নিষেধকে সম্মান প্রদর্শন, অজ্ঞলোকদেরকে এসব কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা ও সঠিক এক অবকাঠামোতে নিয়ে আসা ছাড়া এসব মুসিবত ও ফিতনা থেকে মুসলমানদের রেহাই পাওয়ার কোন উপায় নেই।
কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ও অসৎকাজের দালালচক্র, অবাধ যৌনচার ও অশ্লীলকাজ ছড়িয়ে দেয়ার মাধমে বর্তমানে মুসলমানদের মাঝে সবচেয়ে ভয়াবহ ফিতনা সৃষ্টি করছে। তারা খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক অশ্লীল কিছু পত্রপত্রিকা, ম্যাগাজিন ও সাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ নিষেধের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। তারা এসব পত্রপত্রিকার পাতায় উলঙ্গ ও যৌনসুড়সুড়িমূলক অশ্লীল ছবি ছাপিয়ে যৌনউত্তেজনা ও নানারকম অন্যায়ের দিকে মানুষকে আহ্বান করছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, এসব পত্রপত্রিকা অপকর্ম, পাপাচার, যৌনউত্তেজনা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হারামকৃত কাজের প্রচার প্রসার করছে ও এসব কাজে উদ্ধুদ্ধ করছে। তাদের এসব অশ্লীল ও পাপাচার কাজের কিছু ধরন নিম্নরূপ:
  • ১- পত্রপত্রিকা ও ম্যাগাজিনের কভারপাতায় এবং ভিতরের পাতায় উলঙ্গ ছবি ছাপানো।
  • ২- নারীকে অতিসাজসজ্জা করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে ফিতনায় প্ররোচিত করা।
  • ৩- দুশ্চরিত্র অশ্লীল কথাবার্তা, লজ্জাসম্মান বহির্ভূত গদ্য ও পদ্য ছাপানো হয় যা উম্মাহর আখলাককে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
  • ৪- ভালবাসার অশ্লীল ঘটনা, উলঙ্গ নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকার ছবি ও সংবাদ ছাপানো।
  • ৫- এসব পত্রপত্রিকা প্রকাশ্য বেহায়াপনা, নারীপুরুষের অবাধ মিলন ও পর্দার বিধানকে উচ্ছেদ করতে প্রকাশ্যে উঠে পড়ে লেগেছে।
  • ৬- উলঙ্গ অর্ধ-উলঙ্গ পোষাক পরিচ্ছেদের প্রতি মুমিন নারীদেরকে উৎসাহিত করে তাদেরকে উলঙ্গপনা, বেহায়াপনা ও পাপাচারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
  • ৭- এসব পত্রপত্রিকা নারী-পুরুষের গলা জড়িয়ে আলিঙ্গন ও চুম্বনরত ছবি প্রকাশ করে।
  • ৮- এসব পত্রপত্রিকার লেখালেখি ও প্রবন্ধগুলো যুবক যুবতীর সুপ্ত যৌন বাসনাকে জাগিয়ে তোলে, ফলে তারা লালসা, পথভ্রষ্টতা, পাপাচার, অন্যায় ও অবৈধ প্রেম ভালবাসায় পতিত হয়ে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কত যুবক যুবতী যে এসব পত্রপত্রিকার কারণে ভালবাসার প্ররোচনায় পড়ে স্বাভাবিক জীবন ও ধর্ম থেকে বিচ্যুতি হয়ে গেছে, তার কোন ইয়ত্তা নেই।
এসব পত্রপত্রিকা অনেক মানুষের চিন্তা চেতনা থেকে শরিআতের বিধিবিধান ও সুস্থ স্বাভাবিক মৌলিক সহজাত প্রবৃত্তি দূরে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এসব পত্রিকা মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাচেতনার মধ্যে কুপ্রভাব বিস্তার করার কারণে অনেকেই গুনাহ, পাপাচার ও আল্লাহর সীমালঙ্ঘন করছে।
আসল কথা হলো এসব পত্রপত্রিকার মূল উপাদান হলো নারীর দেহকে পুঁজি করে মানুষের কামভাবকে জাগিয়ে তুলে হারামপন্থায় ব্যবসা বাণিজ্য করা, আল্লাহর হারামকৃত বিষয়কে হালাল মনে করা, মুমিন নারীদের চরিত্রহরণ করা, ইসলামি সমাজকে পশুত্বের দিকে ঠেলে দেয়া যেখানে সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ নেই, নেই আল্লাহর সুন্দর, পবিত্রতম ও ভারসাম্য শরিআতের প্রয়োগ। বর্তমানে এসব অবস্থা অনেক সমাজেই লক্ষ্য করা যায়, এমনকি অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সমকামিতা ও নারী পুরুষের অবাধ যৌনমিলন যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এসব পত্রপত্রিকার উপরোল্লেখিত কুপ্রভাব ও অসৎউদ্দেশ্যের কারণে সৌদী আরবের একাডেমিক গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি এসব পত্রপত্রিকার প্রকাশ, প্রচার প্রসার, বাজারজাতকরণ সম্পর্কে নিন্মোক্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে:
প্রথমত: এসব পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা হারাম। চাই তা সাধারণ পত্রিকা হোক বা নারীদের পোশাক পরিচ্ছেদ সজ্জিত আলাদা পত্রিকা হোক। যারা এসব কাজ করবে তারা নিন্মোক্ত আয়াত অনুযায়ী গুনাহ ও অন্যায়ে পতিত হবে। আল্লাহ বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
নিশ্চয় যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আযাব। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না[সূরা : আন্-নূর: ১৯]
দ্বিতীয়ত: এসব পত্রপত্রিকায় প্রকাশনা, প্রচার প্রসার, সম্পাদকীয় বা সাংবাদিকতা করা বা যেকোন ধরনের সহযোগিতা করা হারাম, অন্যায় কাজে সহযোগিতার শামিল। আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا تَعَاوَنُوا عَلَى الْإِثْمِ وَالْعُدْوَانِ وَاتَّقُوا اللَّهَ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ
মন্দকর্ম ও সীমালঙ্ঘনে পরস্পরের সহযোগিতা করো না। আর আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ আযাব প্রদানে কঠোর[আল-মায়েদা: ২]
তৃতীয়ত: এসব পত্রপত্রিকার বিজ্ঞাপন ও প্রচারের কাজ করাও হারাম। কেননা এসব করা অন্যায় কাজের দিকে দাওয়াত দেয়ার শামিল। আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: «مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى، كَانَ لَهُ مِنَ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا، وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ، كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ، لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا»
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি হিদায়াতের দিকে আহবান জানায় তার জন্য সে পথের অনুসারীদের পূরস্কারের অনুরূপ পুরস্কার রয়েছে। এতে তাদের পুরস্কার থেকে কিছুমাত্র ঘাটতি হবে না। আর যে ব্যক্তি গোমরাহীর দিকে আহবান জানাবে তার উপর সে পথের অনুসারীদের গোনাহের অনুরূপ গোনাহ বর্তাবে। এতে তাদের গোনাহসমুহ কিছুমাত্র হালকা হবে না [1]

চতুর্থত: এসব পত্রপত্রিকা বেচাকেনা করা ও এর দ্বারা উপার্জন করা হারাম। কেউ ইতিপূর্বে এসব কাজ করলে তাকে তাওবা করতে হবে এবং অন্যায়পথে উপার্জিত অর্থ থেকে মুক্ত হতে হবে।

পঞ্চমত: এসব পত্রপত্রিকা ক্রয়ও হারাম। এছাড়া এগুলো ক্রয় করা মানে এসব অন্যায় কাজকে উৎসাহ ও সহযোগিতা করা। অতএব মুসলমানকে তার বাড়িতে অধীনস্তদেরকে এ ব্যাপারে সতর্ক করা উচিত। কেননা প্রত্যেক মুসলমানই দায়িত্বশীল আর সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে কিয়ামতের দিন জিজ্ঞাসিত হবে।

ষষ্ঠত: মুমিনের উচিত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগত্য ও ফিতনা ফাসাদ থেকে বিরত থাকতে এসব নোংরা পত্রপত্রিকার দিকে চোখ মেলে না তাকানো। কেননা মানুষ গুনাহ থেকে মুক্ত নয়। শয়তান তাকে যেকোন সময় ধোঁকা দিতে পারে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শয়তান বনী আদমের শিরা উপশিরায় চলাচল করে। ইমাম আহমদ রহ. বলেছেন, কোন কোন দৃষ্টিপাত ব্যক্তির অন্তরে রোগ ব্যাধি সৃষ্টি করে। অতএব, যে ব্যক্তি এসব পত্রিকার সাথে জড়িত আছে তার অন্তর ও জীবন বিনষ্ট হয়ে যাবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে অনর্থক ও বিফল কাজে নিয়োজিত থাকবে। কেননা অন্তরের বিশুদ্ধকরণ ও জীবনের সংশোধন একমাত্র আল্লাহ, তাঁর ইবাদাত বন্দেগী, তাঁর সমীপে মুনাজাত, একনিষ্ঠার সাথে তাঁর জন্য কাজ করা ও তাঁর ভালবাসায় অন্তরকে পূর্ণ করে রাখা ইত্যাদির সাথেই সম্পৃক্ত।

সপ্তমত: মুসলিম শাসকদের উচিত মুসলমানদেরকে এ ব্যাপারে উপদেশ দেয়া, দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতিকর এসব কাজ থেকে তাদেরকে বিরত রাখা, তাদেরকে এসব ক্ষতিকর পত্রপত্রিকা প্রকাশ প্রচার থেকে বিরত রাখা। এটা আল্লাহ ও তাঁর দীনের স্বার্থেই করা উচিত। আল্লাহ বলেছেন,
وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে[সূরা : আল-হাজ্জ: ৪০-৪১]
সব প্রশংসা আল্লাহর, দরুদ ও সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার পরিজন ও সাহাবীগনের উপর বর্ষিত হোক।
অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন আল-আযহারী 
সম্পাদনা : ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহীএকাডেমিক গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি
ফতোয়ার সূত্র: একাডেমিক গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। সদস্য: সালিহ ইবন ফাওযান, আবু যায়েদ বকর ইবন আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহ ইবন আব্দুর রহমান আল-গাদইয়ান। প্রধান, আব্দুল আজিজ ইবন আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মদ আলে আশ-শাইখ।[1] মুসলিম, হাদীস নং ২৬৭৪।সূত্রঃ http://islamhouse.com/bn/ 

No comments:

Post a Comment